গত শুক্রবার সিএমপির কর্ণফুলী থানায় ভুক্তভোগী জুয়েল নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার থানা নম্বর-০৮। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিএমপি বন্দর জোনের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ বদরুল আলম মোল্লা।
মামলায় অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের এম মঈন উদ্দিন (৪৬), মো. শাহেদুর রহমান প্রকাশ শাহেদ (৫০), মির্জা আজাদ (৪০), মো. আব্দুর রাজ্জাক (৪০), জাফর আহমদ (৫৮), মো. ইমরান পাটোয়ারী (২৯), আব্দুর শুকুর (৩৫) ও জহিরুল আলম (৪০)।
গত ৭ মার্চ কর্ণফুলী থানায় দেওয়া মামলার এজাহারে ভিকটিম জানায়, তিনি একজন ব্যবসায়ী। অভিযুক্তরা বিভিন্ন সময়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিলো। গত বুধবার (৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে, জুয়েল ইছানগর জামে মসজিদে তারাবি নামাজ শেষে গেটের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে, বাড়ি যাওয়ার পথে চরপাথরঘাটা (৮নম্বর ওয়ার্ড) সাইক্লোন সেন্টারের পূর্ব পাশে রাস্তার উপর পৌঁছালে, অজ্ঞাত ৯-১০ জন লোক তিনটি সিএনজিযোগে এসে দাবি করে যে, জুয়েলের বিরুদ্ধে একটি মামলা আছে। এরপর তারা জুয়েলকে জোরপূর্বক সিএনজিতে তুলে থানায় নেওয়ার কথা বলেন এজাহারে।
তবে থানায় না নিয়ে, তারা জুয়েলকে শাহ আমানত সেতু দিয়ে ফিশারি ঘাটের দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে কালো রঙের একটি প্রাইভেট কারে তুলে লাল দীঘির মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে নানা প্রশ্ন করা হয়। পরে, মাস্ক পরিহিত ৯-১০ জন লোক জুয়েলকে চারজনের কাছে হস্তান্তর করে। মাস্ক পরা ৪ জন তাকে একটি সাদা প্রাইভেট কারে তুলে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাতে থাকে।
রাত সাড়ে ১টার দিকে, গাড়িটি কাজীর দেউড়ী এলাকায় রয়েল হাট রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ায়। মাস্ক পরিহিতরা জুয়েলকে গাড়ির মধ্যে রেখে দরজা লক করে দেয়। ৩০ মিনিট পর, তারা প্রশাসনের লোক পরিচয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। জুয়েল ১০ লাখ টাকা দিতে অপারগতা জানালে, তারা ৫ লাখ টাকা দাবি করেন।
পরে, মাস্ক পরা ৪ জন লোক জুয়েলের মোবাইল ফোন থেকে সাজ্জাদ নামের একজনের নম্বরে কল করে তার ছোট ভাই মুন্নার সঙ্গে কথা বলেন এবং ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে, ৩ লাখ টাকা হলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। যা ভিকটিম জুয়েল বারবার তাঁর পিতাকে মুঠোফোনে জানান বলে উল্লেখ করেছেন।
তার কিছুক্ষণ পর, কর্ণফুলী থানার ওসি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা কাজীর দেউড়ী মোড়ে গাড়ি তল্লাশি করতে গিয়ে মাস্ক পরা ৪ জনকে বলেন, ‘টাকা লাগবে না, আমরা তোমাকে ছেড়ে দেবো, চিৎকার করো না।’
এরপর, তারা গাড়িটি ঘুরিয়ে হল টোয়েন্টিফোর এর সামনে নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ৩ টার দিকে, জুয়েলকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং নামার সময় তারা বলেন, এজাহারে উল্লেখ করা আসামিরা তাদেরকে প্ররোচিত করেছে ভিকটিমকে এনে টাকা আদায় করার জন্য।’
পরে, জুয়েল একটি রিকশায় করে কোতোয়ালী থানায় গিয়ে ওসি কোতোয়ালী ও সেখানে উপস্থিত ওসি কর্ণফুলীকে ঘটনার বিস্তারিত জানান। এ বিষয়ে, কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ভিকটিমের বক্তব্যে অসঙ্গতি, তদন্তের দাবি সচেতন মহলের
কর্ণফুলীতে শহিদুল আলম জুয়েলের অপহরণের ঘটনায় মামলার এজাহার ও ভিকটিমের বক্তব্যের মধ্যে বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। মামলায় উল্লেখিত ঘটনাপ্রবাহ এবং ভিকটিমের গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য উঠে এসেছে, যা এ মামলার গভীর তদন্তের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে তুলছে।
ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা, প্রশ্নের মুখে অভিযোগ
ভিকটিম প্রথমে দাবি করেন, তাকে চট্টগ্রাম মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু মামলার এজাহারে এমন কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্যকে আসামি করা হয়নি।
এছাড়া, এজাহার নামীয় আসামিরা পূর্বে ভিকটিমকে হুমকি দিতেন বলেন উল্লেখ করলেও তিনি অতীতে আসামিদের বিরুদ্ধে নিকট থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেননি, যা মামলার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
অভিযুক্তরা এলাকায় সুপরিচিত ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে অপহরণের কোনো অভিযোগ ছিল না। তাহলে হঠাৎ তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেন উঠল? এটি গভীর তদন্তের দাবি রাখে।
স্থানীয় লোকজন ও অভিযুক্তদের বক্তব্য
স্থানীয়দের ধারণা, এই ঘটনাটির পেছনে ইছানগরের একটি কোম্পানির জাহাজে জাটকা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন। আবার অনেকেই একে পরিকল্পিত নাটক বলে মনে করছেন। তবে প্রকৃত সত্য জানতে অনুসন্ধান চলছে।
অন্যদিকে, ৮ অভিযুক্তদের দাবি ভিকটিম আওয়ামী পরিবারের সন্তান এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। হীন উদ্দেশ্যে বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। ভিকটিম ঘটনার রাতে পুলিশের সামনে এক কথা বললেও মামলায় সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প তৈরি করেছেন। তারা আরও দাবি করেন, মহানগরের এক নেতার নির্দেশে তার লোকজনও এই ঘটনার পিছনে জড়িত। যা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
বিবরণে বিভ্রান্তি ও মুক্তিপণের দর কষাকষি
ভিকটিম দাবি করেন, তাঁকে সিএনজি, প্রাইভেট কার ও রিকশায় বিভিন্ন স্থানে ঘুরানো হয়। তবে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইছানগর থেকে সরাসরি তিনটি সিএনজিতে করে লালদীঘি, এরপর প্রাইভেট কারে কাজীর দেউড়িতে তাকে নিয়ে যান বলে জানান। প্রথমে ছাত্র পরিচয়ে তুলে নেওয়া অপহরণকারীরা পরে আর কোথাও ছিলেন না, বরং নতুন ৪ জন মাস্ক পরিহিত ব্যক্তির কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান। কিন্তু তাঁরা তো এজাহারে উল্লেখ করা আসামিরা নয়। সুতরাং যা তদন্তের বিষয়।
মুক্তিপণের দাবিতেও রয়েছে নানা অসঙ্গতি
প্রথমে ১০ লাখ টাকা চাওয়া হলেও, পরে তা ৫ লাখে নেমে আসে এবং শেষে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে বিকাশে কিছু! ভিকটিমের বাবার সঙ্গে ফোনালাপে মুক্তিপণের পরিমাণ বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, যা সন্দেহজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি শেষে একদম সুস্থ্য শরীরে স্বেচ্ছায় রাত সাড়ে তিনটায় রিকশায় করে কোতোয়ালী থানায় আসা রহস্যের ইঙ্গিত দেয়।
মোবাইল ট্র্যাকিং ও ভিন্ন অবস্থান
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনার রাতে ভিকটিমের মোবাইল ট্র্যাক করে তার অবস্থান খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী, লালখানবাজার ও শেষে আবারো কোতোয়ালী এলাকায় পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ইছানগর থেকে সরাসরি সিএনজিতে নতুন ব্রিজ হয়ে লালদীঘি ও কাজীর দেউড়িকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, এরপর ছেড়ে দিলে সে রিকশায় করে কোতোয়ালী থানায় যান। তাহলে ঘটনার রাতে ভিকটিমের ফোন লোকেশন কেন খুলশী, লালখান বাজার ও পাঁচলাইশে দেখিয়েছিলো? এছাড়া, ভিকটিমের দাবি অনুযায়ী, তার মোবাইল ফোন অপহরণকারীদের কাছেই ছিল না, তাহলে এই অবস্থান পরিবর্তন কীভাবে হলো? তাহলে কী ভিকটিম নিজেই ঘুরেছেন কিনা প্রশ্ন গভীর করে তদন্তে।
তদন্ত ছাড়া হয়রানি নয়: সচেতন মহল ও মানবাধিকার সংগঠক
সচেতনমহল ও বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান মনে করছেন, ভিকটিমের বর্ণনায় অসঙ্গতি ও মামলার বিভিন্ন অসংলগ্নতা ও অস্পষ্টতার কারণে কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করে, ঘটনার পেছনের ঘটনা অনুসন্ধান করা জরুরি। নিরীহ কোন নাগরিক যেন হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনকে সতর্কতা অবলম্বন করতে তিনি আহ্বান জানান। পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, অপহরণের প্রকৃত কারণ, মুক্তিপণের আলোচনা ও অপহরণকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেশাদারিত্বের সাথে অধিকতর তদন্ত করা হবে।