বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় দুই উৎসের একটি প্রবাসী আয় ব্যাংক মাধ্যমে আসা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই প্রবাসী আয় কমেছে। এ ছাড়া গত মাসের শুরুতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট সময়ের আমদানির দায় বাবদ ১৩১ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। অন্যদিকে রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার বিক্রি করাও হচ্ছে। এসব কারণেই মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ হিসেবে বা জিআইআর অনুসারে গত বুধবার দিন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। যা গত ৫ সেপ্টেম্বরে ছিল ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত দেড় মাসে রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
আর গত জুন শেষে জিআইআর অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সাড়ে চার মাসে রিজার্ভ কমেছে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
মূলত গত জুন থেকে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে গ্রস আন্তর্জাতিক রিজার্ভ বা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-৬ বা বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে মোট (গ্রস) রিজার্ভ থেকে ইডিএফ (রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিল), আইডিএফ (অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল) ও বিভিন্ন দেশকে দেয়া ঋণ বাদ দিয়ে জিআইআর রিজার্ভের হিসাব করা হয়।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসেবে গত বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ২৬ হাজার ৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত ৫ সেপ্টেম্বরে ছিল ২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২১ সালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে উঠেছিল।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে কৃত্রিমভাবে আটকে রাখা দর এক ধাক্কায় অনেক বেড়েছে। বিশ্ববাজারে সুদহার এবং পণ্যমূল্য বাড়ার ফলে একই পণ্য কিনতে ডলার খরচ হয়েছে অনেক বেশি। ব্যাংকাররা বলছেন, ডলারের দর ধরে রাখার নীতি রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়েছে। অর্থ পাচারকারী ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে কম রেটে ডলার পাওয়া সহজ করেছে।
ব্যাংকাররা জানান, দর নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ডলারের দাম ঠিক করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুরুতে রপ্তানিতে ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে ডলারের দর ঠিক করা হয় ১০৮ টাকা। সেখান থেকে প্রায় প্রতি মাসে দর বাড়িয়ে এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দুই ক্ষেত্রেই ১১০ টাকা করা হয়েছে।
যদিও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে এখন প্রবাসীরা পাচ্ছেন ১১৭ থেকে ১২০ টাকা। বাড়তি চাহিদার কারণে অনেক ব্যাংক বেশি দরে ডলার কিনেছিল। তবে নির্ধারিত দর মানতে কড়াকড়ি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকে পরিদর্শন করে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে জরিমানা করা হয়। এতে বাজারে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে রেমিট্যান্স আরও কমছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে ৪৯২ কোটি ডলার দেশে এসেছে। গত সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে, যা ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ড শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন। আবার ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে প্রতি মাসে একটু করে বাড়ানো হচ্ছে। ফলে দর একটু হলেও বাড়বেই এমন ধারণা থেকে প্রবাসী, রপ্তানিকারকসহ সব পর্যায়ে ডলার ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। বেশি লাভের আশায় অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা দরে নগদ ডলার কিনে ঘরে রাখছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রিজার্ভ বাড়ানোর এখন বড় উপায় বিদেশি ঋণ, বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স বাড়ানো। তবে চাইলেই উল্লেখযোগ্য হারে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব না। আবার সুদহার বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ কমছে। এর মধ্যে এসঅ্যান্ডপি এবং মুডিসের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের রেটিং বিষয়ে খারাপ বার্তা দিয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের কারণে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। তাই চাইলেও এখন রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব না।
জানতে চাইলে পলিসি রির্সাচ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা টাইমসকে বলেন, বর্তমানে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো অবস্থানে নেই। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতেই হবে। এতে করে রিজার্ভের আরও রক্তক্ষরণ হবে। তবে নির্বাচনের আগে রিজার্ভ বাড়ানোর তেমন কোনো উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পর সরকারের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারে আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
ঢাকাটাইমস