পুলিশ কর্তৃক কক্সবাজারে মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে গুলি করে এবং সিলেটের রায়হানকে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশব্যাপি প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। বছরের এই আলোচিত ঘটনার ফাঁকে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আরো অনেক মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ দমনে ২০২০ সালেও পুলিশ ও র্যাবকে ব্যবহার করে একের পর এক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদি সরকার। এমনকি করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পরও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্মম নির্যাতন, পিটিয়ে হত্যা এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হয়রানিও থেমে ছিলো না।
এরই মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ক্রসফায়ার, গুম আর নির্যাতনের অভিযোগে র্যাবের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে গত ২৮ অক্টোবর ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠিও দিয়েছে মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির ১০ সদস্য । তবে, মানবাধিকারের এই ইস্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গত এক দশকে খুনের ভয়াল রাজত্ব কায়েম করেছে শেখ হাসিনার সরকার।
আওয়ামী পন্থি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চলতি বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন ২১৯ জন। এর মধ্যে গ্রেফতার দেখানোর আগে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে ১৪৭ টি। গ্রেফতার দেখানোর পর ক্রসফায়ার ঘটেছে ৩৯ টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটকের পর গ্রেফতার দেখানোর আগে নির্যাতনে মারা গেছে ৫ জন। গ্রেফতার দেখানোর পর হেফাজতে নির্যাতনে মারা গেছে ১১ জন।
এছাড়াও গ্রেফতারের আগে গুলি করে মারা হয়েছে ৮ জনকে। কারাগারে আত্মহত্যা করেছে ১ জন। অসুস্থ হয়ে মারা গেছে ৩ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ জন মারা গেছে এবং রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে ৪ জনের।
অর্থাৎ, চলতি বছরেও কমেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। শুধু তাই নয়, এতটুকু বদলায়নি হত্যা পরবর্তী বয়ানও।
অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার পর আসামির সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা চালায়, এতে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে আসামি নিহত হয় — এমন সাজানো মিথ্যা বয়ান এ বছরও দিয়েছে শেখ হাসিনার অনুগত পুলিশ ও র্যাব। আর এসব হত্যাকাণ্ডগুলোতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে সরাসরি সহায়তা করেছে বর্তমান পুলিশ প্রধান ইসলামবিদ্বেষী বেনজীর আহমেদ ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটোরিং সেন্টার এর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান গং। এছাড়া শেখ হাসিনা তার প্রভু রাষ্ট্রের শেখানো ‘জঙ্গি’ তকমা ব্যবহার করে গ্রেফতার করেছে ইসলামপন্থী অনেক তরুণকে। এদের অনেকের খোঁজ আজও মেলেনি।
তবে ২০২০ সালে তথাকথিত ক্রসফায়ারের দুটি ঘটনা গোটা দেশের মানুষকে সংক্ষুব্ধ করেছিল । সোস্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। ঘটনা সামাল দিতে জড়িত পুলিশ অফিসারদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এর একটি হলো কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যাকাণ্ড এবং অপরটি হলো দশ হাজার টাকা না দেওয়ায় পুলিশের হেফাজতে রায়হানকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা।
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড:
বিদায়ী বছরের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড। গত ৩১ জুলাই রাতে মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত ১৩ ডিসেম্বর আলোচিত ওই হত্যা মামলায় চার্জশিট দাখিল করেছে র্যাব।
১৫ জনকে অভিযুক্ত করে দাখিল করা ওই চার্জশিটে র্যাব জানায়, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ইয়াবা বাণিজ্য। পুলিশের এই কর্মকর্তার ইয়াবা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মের কথা জেনে যাওয়ায় সিনহাকে হত্যা করা হয়। এই প্রদীপ কুমার দাশকেই ক্রসফায়ারের পুরস্কার হিসেবে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
এই হত্যার ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার কক্সবাজারের আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়।
সিলেটে পুলিশের হাতে রায়হান হত্যা :
গত ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট মেট্রোপলিটনের আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় যুবক রায়হানকে। এ ঘটনায় নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে পরের দিন ১২ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
রায়হান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র এবং এসআই আবদুল বাতেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর আগে গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে সেখানকার আদিবাসীদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়ে আসে পুলিশ।
থেমে নেই ডেথ স্কোয়াড:
প্রসঙ্গত, এক সময়ে শেখ হাসিনার সহযোগি হিসাবে আত্মস্বীকৃত বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী কর্ণেল অব: শহিদ উদ্দিন খান ও তাঁর বন্ধু সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমদের একটি কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। এই কথোপকথনে শোনা যায়, জেনারেল আজিজ তাঁর বন্ধুকে বলছেন, গুম ও খুনের সাথে জড়িত হচ্ছেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল তারেক সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান। ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতেই এই গুম-খুনে তারা জড়িত। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি শাসনকে টিকিয়ে রাখতে জেনারেল তারেক সিদ্দিকী ও জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে র্যাবকে বছরের পর বছর ব্যবহার করছে শেখ হাসিনার সরকার।
তবে নিরাপত্তা বাহিনীর এসব গুম ও খুনের ঘটনাকে বরাবরের মতোই অস্বীকার করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
ক্রসফায়ারের সাফাই গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে, “মাদক ব্যবসায়ীরা সশস্ত্র থাকেন। তাঁরা যখন হামলা চালান, তখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। এ ছাড়া প্রতিটি গুলিবর্ষণের ঘটনা জেলা প্রশাসক তদন্ত করে। র্যাব কাউকে গুম করেনি বা নির্যাতনও করে না।”