কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আরো এক আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ নিয়ে তিনজন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছেন। তাদের প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনজনই প্রায় একই ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন। উপরন্তু মামলার প্রধান আসামি বাইট্টা কামাল বলেছেন, সাগরে জলদস্যুতার অভিযোগেই ১০ জেলেকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
গত সোমবার ৫ দিনের রিমান্ড শেষে এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারভূক্ত ১ নম্বর আসামি মহেশখালী দ্বীপ উপজেলার মাতারবাড়ির সাইরার ডেইলের বাসিন্দা ট্রলার মালিক বাইট্টা কামাল ও ৪ নম্বর আসামি ট্রলার মাঝি করিম সিকদারকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আদালতে আসামি বাইট্টা কামাল স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সন্মতি প্রকাশ করেন। অপর আসামি করিম মাঝি জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কক্সবাজার সদরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদ আসামি বাইট্টা কামালের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। সোমবার বিকাল সাড়ে ৪ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত কামালের জবানবন্দি নেন বিচারক। এর আগে গত রবিবার বাঁশখালীর ফজল কাদের মাঝি ও আবু তৈয়ুব মাঝি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছেন।
তিন আসামির স্বেচ্ছায় জবানবন্দি প্রদানের কথা নিশ্চিত করলেও তারা (আসামি) আদালতে কি বলেছেন তা বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তদন্তকারি কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দূর্জয় বিশ্বাস। তবে তিনি বলেছেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি এবং ট্রলার মালিক বাইট্টা কামাল জবানবন্দিতে ঘটনায় জড়িত অন্তত ২০ জনের নাম প্রকাশ করেছেন।
নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, আসামি বাইট্টা কামাল সেদিনের ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি ঘটনার দিন কক্সবাজার শহরে অবস্থান করছিলেন বলে জানান। তিনি আদালতকে জানান, ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে তার ভাই আনোয়ারের (মামলার এজাহার নামীয় পলাতক আসামি) মালিকানাধীন ট্রলারে দস্যুতা সংঘটন নিয়ে। নাম বিহীন ট্রলারের মালিক নিহত শামশু মাঝি বাইট্টা কামালের ভাই আনোয়ারের মাছ ধরা ট্রলারে ডাকাতি (দস্যুতা) করার কারণে অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা ক্ষুব্ধ হয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।
পুলিশের একটি সুত্র মতে আরো জানা গেছে, জবানবন্দিতে বাইট্টা কামাল আরো জানান, সাগরে মাছ ধরারত মাতারবাড়ির আবদুল গফুর, বেলাল ও আক্কাসের সাথে তার মোবাইলে গত ৯ ও ১০ এপ্রিল কয়েক দফা কথা হয়েছে। সাগরে মাছ ধরারত ট্রলারে থাকা এই তিন জেলেই তাকে (বাইট্টা কামাল) নিশ্চিত করে যে, নিহত শামশু মাঝির ট্রলারের লোকজন তার ভাই আনোয়ারের ট্রলারের লোকজনকে মারধরের পর ডাকাতি করেছে।
৯ এপ্রিল ভোরে আনোয়ারের ট্রলারে ডাকাতির ঘটনার পর সাগরে মাছ ধরারত আফসার মাঝি ও বাবুল মাঝি তাদের দুই ট্রলারে বাঁশের মাথায় কাপড় বেঁধে (ডাকাতির সংকেত) উড়িয়ে দেয়। গভীর সাগরে ডাকাতির সংকেত পেয়েই তাৎক্ষনিক ১০/১২ টি ট্রলার একই স্থানে জড়ো হয়ে শামশু মাঝির নামবিহীন জেলেবেশি ট্রলারটিকে ধাওয়া দিয়ে ধরে ফেলে। এরপর এসব ট্রলারের ক্ষুব্ধ জেলেরা শামশু মাঝির ট্রলারে থাকা লোকজনকে এলোপাথাড়ি মারতে থাাকে।
সে সময় সাগরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শি আবদুল গফুর, বেলাল ও আক্কাসের বরাত দিয়ে বাইট্টা কামাল তার জবানবন্দিতে জানান, এতগুলো ট্রলারের ক্ষুব্ধ জেলে একটি ট্রলারের জেলেদের পেয়ে বরফ ভাঙ্গার কাঠের হাতুড়ি, বৈঠা, কাঠ ও লোহার রড দিয়ে যার যেমন ইচ্ছা তেমন করে মারতে থাকে। মারের চোটে সব জেলে মারা যায়। এরপর তাদের লাশ গুম করার ফন্দি করে সবার মরদেহ ট্রলারটির বরফ রাখার হিমাগারে ঢুকিয়ে পাটাতনে পেরাক মেরে দেয়। এক পর্যায়ে ট্রলারটি ফুটো করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। জবানবন্দির পর আদালত বাইট্টা কামালকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ প্রদান করেন।
এদিকে এ মামলায় গত ২৫ এপ্রিল চকরিয়া উপজেলার বদরখালী এলাকা থেকে গিয়াস উদ্দিন মুনির (৩২) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। মুনির বদরখালী এলাকায় মো. নুর নবীর ছেলে। গত রবিবার দুপরে কক্সবাজার সদরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চজ্ঞা এ আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। মুনিরকে যে কোনো সময় রিমান্ডের জন্য পুলিশ নিয়ে যাবে বলে জানান মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দূর্জয়।
প্রসঙ্গত গত ২৩ এপ্রিল গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধিন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা নামবিহীন ট্রলারটিকে নাজিরারটেক উপকূলে নিয়ে আসে। ওই ট্রলারের হিমঘর থেকে হাত-পা বাঁধা ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ইতোমধ্যে উদ্ধার হওয়া ছয়জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করলেও মর্গে রয়ে গেছে চারজনের মরদেহ ও একটি কংকাল। ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এ পাঁচজনের পরিচয়।