গত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’র তালিকায় ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ছোটভাই হারিছ আহমেদের নাম। কিন্তু, গত ১২ ফেব্রুয়ারির পর আচমকা সে নাম সরিয়ে নেওয়া হয়। এর তিনদিন পর আবারও তা দেখা যায় ওয়েবসাইটে।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’র তালিকায় হারিস আহমেদের নাম।
কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা’র প্রতিবেদন মতে, হারিছ আহমেদ ও তার দুই ভাই আনিস আহমেদ ও তোয়ায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ ১৯৯৬ সালে ব্যবসায়ী ও একটি রাজনৈতিক দলের নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হন। সেই মামলায় হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের হয় যাবজ্জীবন সাজা আর জোসেফের হয় মৃত্যুদণ্ড।
সংবাদমাধ্যমটির ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে হারিছ ও আনিসকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর হারিছ ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি যান হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে। বর্তমানে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি মোহাম্মদ হাসান পরিচয়ে সেখানে বসবাস করছেন।
২০১৯ সালে কিছু সময়ের জন্যে হারিছের নাম ইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড’র তালিকায় ছিল।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মো. সোহেল রানাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়, কিসের ভিত্তিতে পুলিশের ওয়েবসাইটের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’র তালিকা থেকে হারিছের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। উত্তরে তিনি এই সংবাদদাতাকে ‘অপেক্ষা’ করতে বলেন।
গতকাল আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট ডেস্ক থেকে এ সংক্রান্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
গতকাল দৈনিক প্রথম আলো’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার হারিছ, আনিসের সাজাও মাফ করেছে। তারা দুজনেই হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। হারিছ দুইটি হত্যা মামলার আসামি ও আনিস ছিলেন একটি মামলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল কর্মী আবু মোরশেদ হত্যা মামলায় ২০০৪ সালের মার্চে তাদের ভাই জোসেফের মৃত্যুদণ্ড এবং হারিছের যাবজ্জীবন হয়। রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় জোসেফের সাজা মওকুফ করা হয়।
সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হারিছ ও আনিসের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। তবে দ্য ডেইলি স্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে যখন মালয়েশিয়াতে দেখা করেছি, তখন তার নামে কোনো মামলা ছিল না। যে একটা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা ছিল, সেটা অলরেডি অব্যাহতিপ্রাপ্ত ছিল। সেই অব্যাহতি মার্চ মাসে হয়েছিল। আমি এপ্রিল মাসে গিয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আল জাজিরা যে স্টেটমেন্টটা দিয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে দিয়েছে। কারণ সেদিন আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে, আমি যদি বলি, সেদিন না কোনো সাজা ছিল, না তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল। তার আগেই যে মামলাটা ছিল, সেটা থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
প্রথম আলো’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। এর এক মাস আগে ২০১৮ সালের ২৭ মে সাজা মওকুফের পর ছাড়া পান জোসেফ।’
‘আর নয় মাস পর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়’, বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, যেদিন মন্ত্রণালয় থেকে সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়, সেদিনই ঢাকার পৃথক দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তার অনুলিপি পাঠানো হয়। এই দুটি বিচারিক আদালত আসামিদের সাজা দিয়েছিলেন। আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রজ্ঞাপন পাওয়ার পর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের নামে থাকা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিনা তামিলে ফেরত পাঠানোর জন্য মোহাম্মদপুর ও কোতোয়ালি থানাকে আদেশ দেন আদালত।’
‘প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিত, সাজানো ও বানোয়াট মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা ও অর্থদণ্ড ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে মওকুফ করা হয়েছে।’
‘হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা মাফ করা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যে শর্ত মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে।’
গতকাল ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে টেলিফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাকে অন্তত ২০ বার ফোন দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
আদালতে আত্মসমর্পণ না করেও কীভাবে এই দুই ভাই ক্ষমা পেলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলো’কে বলেছেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সাজা মওকুফের জন্য কোনো আসামিকে উপস্থিত থাকতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’
কিন্তু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘কোনো আইনগত অধিকার পলাতক আসামি পায় না। আইনগত অধিকার পেতে হলে তাকে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করতে হয়।’
হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এদের (হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদ) সাজা মওকুফের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। না জেনে কিছু বলতেও পারব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে একজন যাবজ্জীবন সাজা মাফের আবেদন করেছিলেন। নাম মনে করতে পারছি না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। আরেকজন নিজেকে মানসিক রোগী বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এইটুকুই আমার মনে পড়ছে।