
ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে সামান্যই। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী এই অঞ্চলেরই আর একটি দেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন, যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা রুটিন বৈঠক। কিন্তু ঢাকায় গত ৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ নিয়ে ভারতে যে পরিমাণ আলোচনা ও চর্চা হচ্ছে, তা প্রায় নজিরবিহীন।
ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা পাকিস্তানি দূতকে বলেছেন, ‘১৯৭১-র ঘটনা আমরা কখনও ভুলতে পারবো না। আমাদের হৃদয়ে সেই যন্ত্রণা চিরকাল রয়ে যাবে।’
আকাশবাণী ও দূরদর্শন-সহ ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তো বটেই, ভারতের প্রথম সারির প্রায় সব সংবাদমাধ্যম প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এই বলিষ্ঠ বক্তব্যকে কুর্নিশ জানিয়েছে।
ভারতের কূটনৈতিক মহল ও নীতিনির্ধারকরাও প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মন্তব্যকে দারুণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের প্রাক্কালে শেখ হাসিনার এই অবস্থান ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীকেও সুদৃঢ় করবে বলে তারা মনে করছেন।
দ্য ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ‘পাকিস্তানের নৃশংসতা যে বাংলাদেশ কখনও ভুলতে পারবে না বা ক্ষমাও করতে পারবে না, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন।’ টাইমস অব ইন্ডিয়া বা ইকোনমিক টাইমস-ও ঠিক একই ধাঁচে খবরের শিরোনাম করেছে।
দিল্লির অন্যতম প্রধান ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানের নির্যাতন আমাদের স্মৃতি থেকে কখনও হারাবে না: শেখ হাসিনা’।
গত জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মিনিট পনেরোর ফোনালাপে দিল্লিতে যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল, এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে সেই ছায়া অনেকটাই কেটে গেলো বলেও দিল্লিতে অনেকে মনে করছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘একাত্তরের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে দেবে না, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বক্তব্যে সেই বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে বলে আমরা মনে করছি।’
দিল্লির শীর্ষস্থানীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের (ভিআইএফ) সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘পাকিস্তানের ব্যাপারে শেখ হাসিনার অবস্থানে কিন্তু কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি পাকিস্তানকে বরাবর ‘আর্মস লেনথে’ রেখেছেন, অর্থাৎ কখনও তেমন ঘনিষ্ঠ হতে দেননি এবং একাত্তরের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত, এই দাবি থেকেও কখনও সরে আসেননি।’
পাকিস্তানি হাইকমিশনারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতেও তার সেই দৃঢ় অবস্থানেরই প্রতিফলন হয়েছে বলে ড. দত্ত মনে করছেন।
ভারতের নামি নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও একাত্তরের যুদ্ধে অংশ নেওয়া মেজর জেনারেল হর্ষ কক্কর বলছিলেন, ‘পাকিস্তানকে বাংলাদেশ যে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না, শেখ হাসিনার এই মন্তব্য ইসলামাবাদ বা করাচির মিডিয়াতে কেউ ছাপবেই না। কিন্তু বাস্তবতা এটাই, বাংলাদেশ আজও চায় পাকিস্তান সেই কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুক।’
সোশ্যাল মিডিয়াতেও বহু সাধারণ ভারতীয় নাগরিক শেখ হাসিনার মন্তব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। রাত্রি বোস নামে একজন লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনার সাহসিকতার প্রশংসা না-করে পারছি না’। টুইটারে জনৈক সুরাজ কাউল মন্তব্য করেছেন, ‘পাকিস্তানের জন্য এটা বিরাট ধাক্কা সন্দেহ নেই।’
তবে ভারতে কেউ কেউ যে একটু অন্য দৃষ্টিতেও বিষয়টি দেখছেন না, তা নয়। ‘দ্য ওয়্যার’ পোর্টাল যেমন লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যে নিজের বাসভবনে পাকিস্তানি দূতের সঙ্গে দেখা করেছেন তাতেই বোঝা যায় দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলছে।’
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ঢাকায় নিযুক্ত প্রাক্তন হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবে আবার এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ যখন যেটা করবে তার পররাষ্ট্র নীতির বিবেচনা থেকে করবে এটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যখন ইমরান খানের সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন কিংবা যখন বলবেন পাকিস্তানের অপরাধ ভোলার নয়। দুটো ক্ষেত্রেই তার দেশের স্বার্থ বা ভাবনাই কাজ করবে।’
‘আমার মনে হয় না ভারতের সেটা নিয়ে অত পোস্ট মর্টেম করার কিছু আছে’ সরাসরি মন্তব্য বর্ষীয়ান এই সাবেক কূটনীতিবিদের।