বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পর্যটন শহর কক্সবাজার। এ নদীর মোহনায় মহেশখালী চ্যানেলের দিকে নদী ও সমুদ্রের একটি অংশ ভরাট করে সম্প্রসারণ হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এ নিয়ে আপত্তি জানালেও বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ফলে নদীতে পলি জমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ নৌপথ।
বিআইডব্লিউটিএর এ-সংক্রান্ত গঠিত ত্রি-বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরের ১০ হাজার ৭০০ ফুট দীর্ঘ রানওয়ের ১ হাজার ৩০০ ফুট তৈরি হয়েছে বাঁকখালী নদীর ভেতর। আর কাজটি করতে ২০২১ সালের দিকে কক্সবাজার প্রান্ত থেকে প্রায় ১ হাজার ১৭৮ মিটার নদীর তীর দখল করা হয়, যা নদীটির মোট প্রস্থের প্রায় ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৫৬০ মিটার সলিড ফিল ও ৬১৮ মিটারে করা হয় পিলার পাইলিং। আয়তন হিসেবে দখলকৃত এ ভূমির পরিমাণ প্রায় ৮০ একর। আর সোনাদিয়া প্রান্তে নদীর মোট প্রস্থের ৪১ শতাংশ বা ৮২০ মিটার রাখা হয়েছে নৌ-চলাচলের জন্য।
নদীতীরের ৬১৮ মিটার অংশে পাইলিংয়ের প্রতিটি পিলারের মধ্যে দূরত্ব রাখা হয়েছে কেবল ২৫ মিটার। ফলে নদীর প্রকৃতি অনুযায়ী দখলকৃত এ অংশে ধীরে ধীরে পলি জমে চর পড়বে। এতে মহেশখালী চ্যানেলটির দিক পরিবর্তন হতে পারে কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
উদ্বেগ প্রকাশ করে বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই না করে কিংবা মতামত না নিয়েই বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নদী মোহনায় পিয়ার তৈরি ও ভরাটের ফলে মহেশখালী চ্যানেল উত্তরে সোনাদিয়া অঞ্চলের দিকে সরে যেতে পারে। আর এভাবে দিক পরিবর্তন হলে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হবে দক্ষিণাঞ্চলের নৌ-যোগাযোগ।
জানা গেছে, বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের শুরুতে নদীতীর ব্যবহার এবং প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নে একটি অস্থায়ী জেটি নির্মাণে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি সরকারের কাছে অনুমতি চায় বেবিচক। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এর প্রায় দুই মাস পর ওই বছরের ২ মার্চ বিআইডব্লিউটিএকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। ত্রি-বিভাগীয় কমিটি করে প্রকল্প এলাকাটি সরজমিন পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০২২ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম কার্যালয়কে নির্দেশ দেয় বিআইডব্লিউটিএ। পরে বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক নয়ন শীলকে আহ্বায়ক এবং প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুরকৌশল) এএসএম আশরাফুজ্জামান ও যুগ্ম পরিচালক মো. সবুর খানকে কমিটির সদস্য করা হয়। ওই কমিটি পরে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে দ্য পোর্ট অ্যাক্ট-১৯৬৬-এর ধারা ৫৪, ৫৫ ও ৫৮-এর আলোকে কক্সবাজার বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে ১ হাজার ১৬ শতাংশ তীরভূমিসহ ২২ হাজার ৬৪০ বর্গমিটার জায়গায় অস্থায়ী জেটি নির্মাণে শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেয়ার সুপারিশ করে। তাই প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি বিআইডব্লিউটিএর অনাপত্তির পাশাপাশি জমির ফি বাবদ ৭১ লাখ ২১ হাজার ৩৮১ টাকা এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আয়করসহ সর্বমোট ৮১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৮৮ টাকা পরিশোধে চিঠি দেয়া হয়। এ বিষয়ে একাধিক চিঠি দেয়া হলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএর দাবি করা ফি পরিশোধ করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত বাঁকখালী নদীর মোহনার একটি অংশে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কক্সবাজার অঞ্চলের পর্যটন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নদীতে পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি আমরা এরই মধ্যে বেবিচককে জানিয়েছি। তাছাড়া ফোরশোর (তীরভূমি) ব্যবহার, অস্থায়ী জেটি নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর পাওনার বিষয়েও মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।’ এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সরকারের এ কর্মকর্তা।
বিআইডব্লিউটিএ দাবি করছে, কক্সবাজার (কস্তুরাঘাট) নদীবন্দরের মাধ্যমে নুনিয়াছড়া ঘাট থেকে শুষ্ক মৌসুমে দুটি পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করে। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এ রুটে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল বাড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ অর্থনেতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অর্থায়নে বাঁকখালী নদীর মোহনায় (পূর্ব প্রান্তে) ও মহেশখালী চ্যানেল অভিমুখে আরো দুটি আরসিসি পর্যটক জেটি নির্মাণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। জেটিগুলো চালু হলে এ চ্যানেল দিয়ে আরো বেশি যাত্রীবাহী ও মালামালবাহী নৌযান যাতায়াত করবে। ফলে এ নৌরুটের নাব্যতা রক্ষাসহ নির্বিঘ্নে নৌযান চলাচলে নৌপথ সচল রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বেবিচক সেটি আমলে নিচ্ছে না। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকখালী নদীর মোহনা ও মহেশখালী চ্যানেল ভরাট হয়ে এ পথে নৌ-চলাচল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করছে বিআইডব্লিউটিএ।
এদিকে বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৬ মে কক্সবাজার বিমানবন্দরে বোয়িং-৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণ উদ্বোধন করেন। তখন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বিমানবন্দরটির রানওয়েকে সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী রানওয়ের দৈর্ঘ্য প্রথমে ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে ৯ হাজার ফুটে এবং প্রস্থ ১২০ ফুট থেকে ২০০ ফুট করা হয়। এখন সেটিকে ১০ হাজার ৭০০ ফুটে উন্নীত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ ফুট থাকবে বাঁকখালী নদীর মোহনা ও সমুদ্রের কিছু অংশে। মূলত সমুদ্রের জল ঘেঁষে বিমান ওঠানামার লক্ষ্যে মহেশখালী চ্যানেলের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে এ রানওয়ে।
আগামী ৫০ বছরের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আগামী বছরের মে মাসের মধ্যে রানওয়ের সম্প্রসারণ কাজটি শেষ হলে বিমানবন্দরে ফ্লাইট অপারেশনের সংখ্যা, বড় বিমান অবতরণ বেড়ে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ভবিষ্যতে কক্সবাজারসংলগ্ন মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশের বড় বড় এয়ারলাইনসের এয়ারক্রাফটও অবতরণ করতে পারবে কক্সবাজারে।
অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০১০-এর ধারা-৩ মোতাবেক অবশ্য কোনো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমির ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া দ্য পোর্ট অ্যাক্ট-১৯০৮ এবং দি ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ অনুসারে গেজেটভুক্ত নদীবন্দরের সীমানায় যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নদীবন্দরগুলোর কনজার্ভেটর হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নেয়া আবশ্যক। যদিও কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের প্রকল্পটি কোনো ধরনের বিধিই অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের।
এ বিষয়ে জানতে কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইউনুছ ভূঁইয়ার মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। সুত্র: বণিক বার্তা