বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে তার ঠিক উল্টো। ডলার সংকট এবং লোহিত সাগরের দ্বন্দ্বের কারণে আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে দাবি করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। লোহিত সাগর সংকটের কারণে জাহাজে করে পরিবহন খরচ বাড়ার ফলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে পারে বলেও তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। তবে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে এখনও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ডলারের বিনিময় হার এখনও ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে।
যদিও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। শিশু খাদ্য ও মাংসের দামের পতনের কারণে এফএও’র বিশ্ব মূল্যসূচক জানুয়ারিতে প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর গত জানুয়ারিতে এ সূচকের মান ছিল সর্বনিম্ন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে গম, ভুট্টা ও ভোজ্য তেলের দাম। কিন্তু বাংলাদেশের পাইকারি বাজারে দাম কমেছে সামান্যই। আর খুচরা পর্যায়ে এ মূল্যহ্রাসের কোনও প্রভাবই পড়েনি। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স বলছে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দুই উৎপাদক ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাতে দেশ দুটিতে সয়াবিন চাষ ত্বরান্বিত হয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম ও গমের দাম ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরলেও দেশের বাজারে আটার দাম আগের অবস্থায় ফেরেনি। একইভাবে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দামও আগের অবস্থায় ফেরেনি। ডলারের উচ্চমূল্য, ফ্রেইট চার্জ, এলসি খোলার জটিলতাসহ নানান কারণ এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বেসরকারি আমদানিকারকরা।
এ প্রসঙ্গে দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গত এক বছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এখন মূল উদ্বেগের বিষয়। আমাদের এখন আমদানিতে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। ঋণপত্র খুলতে ১২০–১২৫ শতাংশ নগদ মার্জিন দরকার হয়। এছাড়া ফ্রেইট (কার্গো বা পণ্যবাহী জাহাজ) চার্জ বাড়ার কারণে কারণে লোহিত সাগরের সংকট পণ্যের দামকে আরও প্রভাবিত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে আটা, ময়দা ও ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী গত মাসে সাদা আটার (খোলা) দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৪.৩৫ শতাংশ। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর প্যাকেট ময়দার দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বাজারে এখন এক কেজির প্যাকেট আটার দাম ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। প্যাকেট ময়দার দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম করলেও আমাদের দেশে ডলারের দাম কমেনি। এ কারণে বাংলাদেশ দ্রুত এর সুবিধা পাচ্ছে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বাজারে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। সাগরে হুতিদের আক্রমণের কারণে আমদানিবোঝাই জাহাজের ক্ষেত্রে কনটেইনার প্রতি চার্জ ইতোমধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে ডলার কিনতে ব্যবসায়ীদের ১২৪ টাকা লাগছে। ফলে এ সময়ে শুধু ডলারের দামের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। এছাড়াও ১২০ শতাংশ অগ্রিম টাকা না দিলে ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের খাদ্য পণ্যের দাম কমলেও এর প্রভাব দেশেরবে বাজারে পড়ছে না।
অবশ্য তিনি জানান, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ গমের দাম কমেছে ২০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে মণপ্রতি ২০ টাকা কমেছে। গত সপ্তাহে কানাডা থেকে আমদানি করা গমের দাম ছিল প্রতি মণ ১ হাজার ৯২০ টাকা। বর্তমানে মণপ্রতি দাম ১ হাজার ৯০০ টাকায় নেমেছে। এছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানি করা গমের দাম এখন মণপ্রতি ১ হাজার ৪৪০ টাকা এসে নেমেছে। গত সপ্তাহে রাশিয়ান গমের দাম ছিল ১ হাজার ৪৬০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে চালের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করতে পারলেও গমের চাহিদা মেটাতে মূলত বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশের বার্ষিক গমের চাহিদা ৭০-৭৫ লাখ মেট্রিক টন, যার ৮৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত বছরের অক্টোবর মাসে প্রতিটন গমের দাম ছিল ২৬৬ মার্কিন ডলার, যা ২০২২ সালে ৩৭৮ ডলার ছিল। অবশ্য এর আগে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ৪০০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গম। বার্ষিক ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১২ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। অবশ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ রয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ২১২ টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ১৪ লাখ ২১ হাজার ৪৪৫ টন এবং গম ২ লাখ ১৮ হাজার ১০২ টন।
এদিকে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে গত সাত মাস ধরে মাংসের মূল্য সূচক অব্যাহতভাবে কমছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারি মাসে এ হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। অথচ সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে গত জানুয়ারি মাসে দেশের বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বর্তমানে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। যদিও বাংলাদেশকে মাংস আমদানি করতে হয় না।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও ডলারের বিনিময়ে হার দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। ফলে বাংলাদেশ হয়তো এখন এর সুফল পাবে না। এছাড়া বাংলাদেশের বাজার এমন পরিস্থিতিতে চলে গেছে যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ে না। কারণ আমদানি হয়ে যখন ভোক্তা পর্যায় আসে তখন মধ্যসত্ত্বভোগীরা বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া খুব বেশি জরুরি।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেছেন মূল্যস্ফীতি কমে আসতে আরও অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি থাকলেও বাংলাদেশে এখন উৎপাদন ও পরিবহন খরচ তুলনামূলক বেশি। এই খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। সরকারের পক্ষে সেটি করা অসম্ভব। এছাড়া, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমেও দাম কমানো সম্ভব; কিন্তু ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। ডলারের বাড়তি দামের কারণেও খরচ বেড়েছে। এর বাইরে কিছু কিছু পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে, যা কমানো দরকার। কিন্তু সেটাও অসম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে এর প্রভাব পড়তে বাংলাদেশে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। ব্যবসায়ীদের যুক্তি হলো আগের বেশি মূল্যে আমদানি করা থাকে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তারা দাম কমায় না। কমে যাওয়া দামের পণ্য আমদানি না হওয়া পর্যন্ত দেশের ব্যবসায়ীরা আগের দামেই পণ্য বিক্রি করেন। আবার কম দামে পণ্য আনলেও তারা বেশি মুনাফার লোভে পণ্য মজুদ করে রাখার চেষ্টা করে। এতে দাম কমে না। এমনকি সরকার কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে দিলেও সেই পণ্যের সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির প্রবণতার মধ্যে থাকলে বাজার সিন্ডিকেট গোষ্ঠী সবাই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দর ১১০ টাকা বেঁধে দিলেও বাস্তবে ডলারের দাম এখন ১২২ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা উচ্চমূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা করতেই পারেন যে কিছু দিনের মধ্যেই ডলারের দর ১২২ টাকা হবে। বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমে আসতে আরও অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।
এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও আমাদের দেশে ডলারের বিনিময় হার এখনও ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এতে দেশের বাজারে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব পড়বে না। শুল্কারোপ করার কারণেও খাদ্যপণ্যের দাম কমছে না। এর বাইরে মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিক ছিল না। তবে এখন মূল্যস্ফীতি কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায়, ধীরে ধীরে পণ্যের দাম কমে আসবে। একটু দেরি হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে।
এদিকে ডলার সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও জোরদার পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। এর আগে ১৫ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে এনে ভোক্তার ওপর চাপ কমাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির মাধ্যমে দ্রুত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করতে গত ২১ জানুয়ারি অর্থ, কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বৈঠক করেছেন। এর আগে ১৭ জানুয়ারি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় ষান্মাসিক (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমলেও অসুবিধা নেই।