
করোনা মোকাবেলার ৪৪ তম দিনে এসে সরকার প্রধান এবং দেশের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে দুরত্ব তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যে গতিতে ছুটে চলতে চান, যেভাবে একটি সমস্যার সমাধান করতে চান, তাঁর ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়- এমন একটি বার্তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিক, নিবেদিত এবং সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর সেই আহ্বান, উদ্যোগ বা পরিকল্পনার কিছুই বুঝতে পারছে না এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে গত কয়েকদিনে মাঠ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে ভিডিও কনফারেন্স, সেই ভিডিও কনফারেন্সে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আগের দিনে নারায়ণগঞ্জে করোনা পরীক্ষার ল্যাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল এবং প্রধানমন্ত্রী তখন হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, ঢাকার এতো পাশে হবার পরেও সেখানে করোনা পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। আবার আজকে একজন নার্স, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় জানিয়েছে যে, তাঁরা যেহেতু চিকিৎসা করছেন, তাঁদেরকে তাই আলাদা থাকা প্রয়োজন, তাঁদেরকে আনা-নেয়ার জন্য আলাদা গাড়ি দেয়ার সাথে তাঁদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা জরুরী। প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর এই কথাটিকে গুরুত্ব দিলেন এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে তিনি যুক্ত হলেন, তখন স্বাস্থ্য কর্মীদের আলাদা গাড়ি দেবার কথা বলে দিলেন। তখন তাঁরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এম্বুলেন্স দেবার কথা বললে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, এম্বুলেন্স তো রোগীদের বহন করার জন্য। বরং তাঁদের জন্য প্রাইভেটকার বা মাইক্রো দেয়া দরকার।
প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন ধরেই পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে কথা বলছিলেন এবং আজ যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়, তখন তিনি তাঁর মোবাইল থেকে সেই ছবিগুলো বের করছিলেন এবং তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, মহানগর হাসপাতালে যে এন-৯৫ মাস্ক দেয়া হয়েছে তা আসল নয় এবং সাপ্লায়ার যেটা দিচ্ছে, তা সঠিক কিনা তা যাচাই করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা ছিল এখানে সুনির্দিষ্ট। প্রধানমন্ত্রী তিনটি বার্তা দিয়েছেন;
প্রথমত, কেনাকাটায় অনিয়ম হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া দরকার।
দ্বিতীয়ত, যারা এই সমস্ত মাল সরবরাহ করছে, তাঁদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।
তৃতীয়ত, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা যেন উপযুক্ত সরক্ষা সরঞ্জাম পান, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অথচ এই সহজ-সরল বার্তাটি বুঝলো না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বরং তাঁরা এটাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলো এবং পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে এমনভাবে তাঁরা তাঁদের ক্রয় নীতির ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করলো যে, তাতে মনে হলো তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিপক্ষ। এই অবস্থায় করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বর্তমান টিম কতটুকু সফল হবে সেই প্রশ্ন উঠছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই করোনা মোকাবেলা করছে বাংলাদেশে এবং সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা একটি। সাধারণ মানুষ এখনো বিশ্বাস করে যে, শেখ হাসিনা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তিনি জনগনের কথা ভাবেন এবং তার নেতৃত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত মনে হয় আমরা করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো। কিন্তু এই এই করোনা সংকট মোকাবিলায় যে মূল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তা এখনো চরম অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী গত চারটি ভিডিও কনফারেন্স, যেখানে তিনি ৫০টি জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রান্তিক পর্যায়ের নার্স, চিকিৎসক, জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছেন সেই কথার যদি অনুরণন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পেত তাহলে এই মন্ত্রণালয়ের গতি, প্রকৃতি পাল্টে যেত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তারা মেনে করছেন যে, প্রধানমন্ত্রী যেভাবে চাইছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেভাবে কাজ করতে পারছেন না। এর কারণ হলো;
প্রথমত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোন সমন্বয় নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী যখন একটি প্রশ্ন করছেন তখন সচিব একরকম আর মহাপরিচালক আরেক রকম উত্তর দিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রান্তিক পর্যায়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছেন এবং সরাসরি তাদেরকে সাহস দিচ্ছেন উৎসাহিত করছেন এবং তাদের পাশে দাড়াচ্ছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই কাজটি করেনি। দীর্ঘদিন ধরে ধরেই তারা এই কাজটি করার চেষ্টাও করেনি। বরং প্রান্তিক পর্যায়ের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের এক ধরণের প্রভুবিত্তের সম্পর্কের আবরণ তৈরী হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।
তৃতীয়ত, কেনাকাটায় নেই স্বচ্ছতা, নেই কোন জবাবদিহীতা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবিলার জন্য দৌড়যাপ করে যে সমস্ত জিনিসপত্র কিনছেন সেটিতে যৌক্তিক স্বচ্ছতা নেই এবং জবাবদিহীতার ব্যবস্থা নেই। বরং মন্ত্রণালয়ে যারা জিনিসগুলো দিচ্ছেন ঠিকাদার, তাদের প্রতি সমর্থণ জ্ঞাপন করার এক ধরণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যা উদ্বেগজনক।
চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী যেভাবে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ধরণের কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। বরং যখন যে সমস্যা আসছে তার এক ধরণের গোজামিলের সমাধান দেওয়ার একধরণের প্রবণতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেখা যাচ্ছে।
পঞ্চমত, সমস্যা মোকাবিলা নয় বরং ধামাচাপা দেওয়ার এক ধরণের প্রবণতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গভীরভাবে আছে।
এই বাস্তবতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কিনা এই নিশ্চয়তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।