পয়লা ফেব্রুয়ারির বহুল আলোচিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রেশ এখনো কাটেনি। এই নির্বাচনে নিঃশব্দে যে নজিরবিহীন নৈরাজ্য হয়েছে তার গোটা চিত্র কখনোই সংবাদপত্রে তুলে আনা সম্ভব হবে না। কারণ, বেশিরভাগ কেন্দ্রেই গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশাধিকার ছিলো এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কবলে। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন সাংবাদিকরা। তারপরেও এসব বাধা-বিপত্তি, নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলিয়ে যতটুকু সম্ভব সিটি নির্বাচনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে নৈরাজ্যের খন্ডিত চিত্র প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে গণমাধ্যম। তেমনি একটি কেন্দ্রের নাম ধানমন্ডির নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ। অবশ্য এ কেন্দ্রের ভেতরের খবর এখনো কোনো গণমাধ্যমে আসেনি। কিন্তু নিঃসন্দেহে অবাক করার মতোই। কেন্দ্র নং ৩২১। বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনের ওই ভোট কেন্দ্রের ভেতরের চিত্র পাওয়া গেছে কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা এক নির্বাচনী কর্মকর্তার সঙ্গে একান্ত আলাপে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান, নিয়মমাফিক ভোটের আগের রাতেই (৩১ জানুয়ারি) ইভিএম ও অন্যান্য ভোট সরঞ্জাম নিয়ে কেন্দ্রটিতে হাজির হন ভোট গ্রহণের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা। এর পরপরই সেখানে এসে উপস্থিত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সাথে সংশ্লিষ্ট থানার এক পুলিশ কর্মকর্তাও। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের কাছে তাদের আবদার, রাতেই ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে কারসাজি করে তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু নির্বাচন কর্মকর্তারা জানালেন, ইভিএমে ভোট নেয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তাতে ভোটার ছাড়া অন্য কারো কিছু করার সুযোগ নেই। নির্বাচন কর্মকর্তাদের এ কথা শুনে নেতাকর্মীরা অনেকটা হতাশ হয়ে যান। হতাশ হয়ে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তাও। বললেন -তাহলে আমার কোনো কাজ নেই! ঠিক আছে সকালে ভোটার বেশিটেশি দেখলে প্রয়োজনে…..। এভাবে অনেকক্ষণ জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনার পর উভয়পক্ষের মাথায় আইডিয়া এলো ‘ভোটার স্ক্যানিং’য়ের। অর্থাৎ শুধুমাত্র নৌকার সমর্থকরাই ভোট দিতে ঢুকতে পারবেন। যেই কথা সেই কাজ। যথারীতি সকাল ৮ টা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শনাক্ত করে করে শুধুমাত্র নৌকা সমর্থক ভোটারদেরকেই বুথে পাঠাতে থাকেন। সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত এভাবেই একতরফা ভোটার শনাক্ত করে ভোটগ্রহণ চলতে থাকে। সবই নিজেদের ভোটার! তবুও জয়পরাজয় নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে ফোনে বিভিন্ন জায়গায় আলাপ-আলোচনা করে সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে নতুন পদ্ধতি নিয়ে আসেন তারা। এই পদ্ধতি হলো ভোটিং মেশিনে শুধুমাত্র ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হবে আর ভোট দেবেন কালো কাপড়ে ঘেরা বুথে থাকা আওয়ামী লীগের লোকেরা। বিকেল সোয়া তিনটা পর্যন্ত এভাবেই ভোট হয় নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে। কিন্তু এই সময় পর্যন্ত খুব কম ভোট কাস্ট হওয়ায় ভোটের হার বাড়ানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের লোকজন।
এরপর চলে আসে নতুন ফর্মুলা! শুরু হয় প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের আঙ্গুলের ছাপে সংরক্ষিত ভোট জালিয়াতির পালা। কেন্দ্রটির ৫ টি বুথে থাকা ভোটিং মেশিনগুলো খুলে আনা হয়। এরপর প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা মিলে তাদের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ৫টি বুথের প্রতিটিতে ২৫টি করে মোট ১২৫ টি ভোট দেন নৌকা প্রতীকে। ইভিএম আর নিতে না পারায় এই ১২৫ টিতেই ক্ষান্ত দিতে হয় কর্মকর্তাদের। এভাবে ভোটগ্রহণের পালা শেষ হলে শুরু হয় ভোট গণনার পালা। কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ৩২১ নং নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিলো ১৪৪৮। সর্বমোট কাস্ট দেখানো হয়েছে ৪৪৯ ভোট। এরমধ্যে নৌকা প্রতীকে পড়েছে ৩৪২ ভোট, ৫ টি পড়েছে হাতপাখাসহ অন্যান্য প্রতীকে। কিন্তু ধানের শীষ প্রতীকে পড়েছে ১০২ ভোট। এতো কিছুর পরেও ধানের শীষ প্রতীকে এই ১০২ ভোট দেখে সংশ্লিষ্ট সবাই হতবাক! এ নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেন তারা। পরে বোঝা যায়, মূলত সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের ভোটার হিসেবে শনাক্ত করে যাদেরকে পাঠিয়েছিলেন তারাই ধানের শীষ প্রতীকে এই ১০২ ভোট দিয়েছেন। অথচ সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে ভোট কাস্ট হয়েছিলো ১৪৫ টি। যার মধ্যে ১০২টিই পড়েছে ধানের শীষ প্রতীকে! আর ‘নৌকা সমর্থক’ শনাক্ত করা এই ভোটাররা যদি ৪ টা পর্যন্তই কালো কাপড়ের ভেতরে নিজের হাতে একান্তে ভোট দিতে পারতো তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো- তা কী ভাবা যায়?
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)