জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানমালায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি একদিকে যেমন জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন তেমনি পঁচাত্তরে দলের নেতৃত্বে ব্যর্থতার কথাও বলেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনায় বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধু যখন আক্রান্ত হয়েছিলেন তখন তিনি সেনাপ্রধান, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদকে ফোন করেছিলেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। আব্দুর রাজ্জাক মারা গেছেন। এখনও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রভাবশালী সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদের নাম উচ্চারণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগে নতুন একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে, প্রধানমন্ত্রী যৌক্তিকভাবেই ইতিহাসের সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের মধ্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের উৎসের সন্ধানে তাগিদ অনুভব করা হচ্ছিলো। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিলো পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগে কার কি ভূমিকা ছিল সে ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ কমিশন হওয়া দরকার। আর এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ইতিহাস এবং গবেষণার একটি নতুন উপাত্ত দিল বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্পর্কটা কখনোই আস্থার এবং বিশ্বাসের ছিল না। তার কারণ শুধুমাত্র যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাই নয়। এছাড়াও আরো অনেক ঘটনা রয়েছে। যেসব কারণে আওয়ামী লীগ সভাপতি দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা তোফায়েল আহমেদের ব্যাপারে আস্থাশীল নন তার মধ্যে রয়েছে,
১. পঁচাত্তরের ঘটনা: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সময় তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। রক্ষী বাহিনীও তার নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়। যদিও তোফায়েল আহমেদ তা অস্বীকার করেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে ৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত তোফায়েল আহমেদ কি ভূমিকা পালন করেছিলেন তা নিয়ে অনেকেরই নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। তোফায়েল আহমেদ যদিও বিভিন্ন সময়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসব তথ্য আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদেরকে যথেষ্ট বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গায় আনতে পারেনি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
২. শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি ১৯৮১ সালে ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর ঘরে-বাইরে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। শুধুমাত্র যে তৎকালীন বিএনপি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তা না, দলের ভেতরেও তাকে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আর এই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তোফায়েল আহমেদ শেখ হাসিনার সহযোগী নেতা ছিলেন না। বরং ড. কামাল হোসেনদের সঙ্গেই তিনি বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে একাধিক মহল মনে করে।
৩. ৮৬ এর নির্বাচন: ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সময়ও তোফায়েল আহমেদ শেখ হাসিনার অনেকগুলো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন এবং ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ঐক্য থাকার কথা ছিল সেই ঐক্য নষ্টের ক্ষেত্রেও তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
৪. ওয়ান-ইলেভেন: ওয়ান-ইলেভেনে তোফায়েল আহমেদ সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দুইবারের বেশি কেউ থাকতে পারবে না। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার যে ফর্মুলা, সেই ফর্মুলা আওয়ামী লীগের যে চার নেতা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
৫. ২০০৮ এর মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি: ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। তিনি মন্ত্রিসভায় একটি চমক দেন। কিন্তু যখন বিরোধীদল আন্দোলন করে তখন তিনি মন্ত্রিসভায় হেভিওয়েটদের অর্থাৎ তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ডাকেন। এই সময়ে রাশেদ খান মেননের সঙ্গে তোফায়েল আহমেদও মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। এটি সে সময় সরকারকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছিল। যদিও তার পরবর্তীতে অন্তবর্তীকালীন সরকার যখন গঠিত হয়, সেই মন্ত্রিসভায় তোফায়েল আহমেদ ছিলেন। ইত্যাদি নানা কারণে শেখ হাসিনার যুগে আওয়ামী লীগে তোফায়েল আহমেদ একজন আস্থার প্রতীক নেতা নন বলেই মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।