বাংলাদেশে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দিয়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে শ্রমিক সংগঠন, ইউনিয়ন ও নাগরিক সংগঠনগুলো।
সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত একটি বিলে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে বেআইনি ধর্মঘটের জন্য জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া বলা হয়েছে, যেসব পরিষেবা বিঘ্নিত হলে জনগণের অসহনীয় কষ্ট হতে পারে সেগুলোকে সরকার অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করতে পারবে।
এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে শ্রমিক সংগঠন, ইউনিয়ন ও নাগরিক সংগঠনগুলোর দিকে থেকে।
শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়ন নেতারা বিলটির সমালোচনা করে বলেছেন এটি প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেবে এবং ‘মালিক বা কর্তৃপক্ষের দৌরাত্ম্য’ আরও বাড়িয়ে তুলবে।
“ধর্মঘট করলে জেল-জরিমানার আইন করার প্রস্তাব মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী,” বলেছেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান।
বৃহস্পতিবার শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল-২০২৩ নামের ওই বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন।
এরপর বিলটি আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়ার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে ১৯৫২ সালের এসেনশিয়াল সার্ভিসেস (মেইনটেন্স) অ্যাক্ট এবং ১৯৫৮ সালের এসেনশিয়াল সার্ভিসেস (সেকেন্ড) অর্ডিন্যান্স রহিত করে নতুন এই আইন করা হচ্ছে।
মূলত এই দুটি আইন এখন ইংরেজিতে থাকার উল্লেখ করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে , “যেহেতু, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন এবং মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার আলোকে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ইংরেজি ভাষায় প্রণীত আইনগুলো বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা আবশ্যক। সেহেতু, অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল, ২০২৩ মহান জাতীয় সংসদের সদয় বিবেচনার জন্য উত্থাপন করা হলো”।
সংসদীয় কমিটি বিলটির ওপর তাদের রিপোর্ট আবার সংসদে আনার পর সেটি সংসদে পাশ করানোর জন্য উত্থাপন করা হবে। বিলটি সংসদে পাশ হয়ে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর আইনে পরিণত হবে।
কিন্তু এখন যেভাবে আছে সেভাবে বিলটি সংসদে পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে এটি মালিকদের সুরক্ষা কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে প্রয়োগ করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
কিন্তু কী আছে এই বিলে
বিলে যেসব বিধিবিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে সরকার জনস্বার্থে দরকার মনে করলে কোনো জরুরি বা অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে পারবে।
সরকার ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার পরও যদি কোনো ব্যক্তি ধর্মঘট শুরু করেন বা অব্যাহত রাখেন তাহলে তিনি ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলছেন ধর্মঘট করা শ্রমিক কর্মচারী বা যে কোনো বিক্ষুব্ধ ব্যক্তির মৌলিক অধিকার।
“এটিকে চাইলেই সরকার বেআইনি ঘোষণা করতে পারে না। এ আইনটি মালিক বা কর্তৃপক্ষের দৌরাত্ম বাড়াবে এবং শ্রমিক কর্মচারীদের বিপন্ন করবে। এর কোনো প্রয়োজন ছিলো না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন প্রস্তাবিত বিলে ধর্মঘট সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেটি ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করবে।
“ জরুরি সেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখার গুরুত্ব থাকে। কিন্তু সংগঠন বা প্রতিবাদের অধিকার সাংবিধানিক । সংশ্লিষ্ট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে আইনটি মালিকদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অপব্যবহার হতে পারে। সেটি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর ও সম্পাদক ফয়জুল হাকিম এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করতে এ বিলটি সংসদে এনেছে।
এছাড়া প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী সরকার প্রয়োজন মনে করলে জনস্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠানে লকআউট (তালাবদ্ধ করা) ও লে-অফ (ছাঁটাই) নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।
অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা কোনগুলো
বিলে বলা হয়েছে কোনো প্রতিবন্ধকতা হলে জনকল্যাণমূলক সেবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন চাকরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিষেবাই অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা।
বিলে বলা হয়েছে , “জননিরাপত্তা বা জনগণের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ সেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এ ধরনের কোনো পরিষেবাও আইনের আওতাভুক্ত থাকবে।”
“জনগণের জন্য অসহনীয় কষ্টের কারণ হচ্ছে বা হওয়ার শঙ্কা আছে এমন পরিষেবা এবং দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারা দেশ বা দেশের কোনো অংশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় কোনো বিষয়ও অত্যাবশ্যক পরিষেবার আওতাভুক্ত হবে।
প্রস্তাবিত বলে যেসব পরিষেবাকে অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ই-কমার্স ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল সেবা, ডিজিটাল আর্থিক সেবা, বিদ্যুৎ সঞ্চালন, বিতরণ, সরবরাহ ও বিক্রয় এবং এ সংক্রান্ত স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ; স্থলপথ, রেলপথ, জলপথ বা আকাশপথে যাত্রী বা পণ্য পরিবহন সেবা; বিমান ও বিমানবন্দর পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত পরিষেবাসহ বাংলাদেশ বেসামরিক ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধিভুক্ত অন্য যেকোনো পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত হবে।
এছাড়া স্থলবন্দর, নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর বা বিমানবন্দরে পণ্য বোঝাই–খালাস, স্থানান্তরসহ সংশ্লিষ্ট বন্দর বা বন্দর সম্পর্কিত পরিষেবা, কোনো পণ্য বা যাত্রীকে ছাড়পত্র প্রদান সম্পর্কিত পরিষেবা; চোরাচালান প্রতিরোধ সম্পর্কিত পরিষেবা; সশস্ত্র বাহিনীর আওতাধীন যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত পরিষেবা এবং দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক স্থাপিত বা প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা; দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য বা মালামাল উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা; খাদ্যদ্রব্য ক্রয়, বিক্রয়, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মজুত, সরবরাহ বা বিতরণের কাজে নিযুক্ত সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবাও এর আওতায় রয়েছে।
অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় আরও যা আছে
প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং পানি সরবরাহ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কিত পরিষেবা; হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা এরূপ প্রতিষ্ঠান এবং ডিসপেনসারি সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা; ওষুধ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা কারখানার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত পরিষেবা; কয়লা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইস্পাত ও সার উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ বা বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা; কোনো তেলক্ষেত্র, তেল শোধনাগার, তেল সংরক্ষণাগার এবং পেট্রলিয়াম বা পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান; টাকশাল ও নিরাপত্তামূলক মুদ্রণ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত হবে।
এর বাইরেও চাকরি বা চাকরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো পরিষেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করা যাবে। এর মধ্যে আছে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে জনকল্যাণমূলক সেবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এ রকম চাকরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো পরিষেবা।
ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলছেন, জরুরি সেবার জন্য এখন প্রচলিত যেসব আইন কানুন আছে সেটিই যথেষ্ট ছিলো। এসব দেখিয়ে ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রস্তাব তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
অন্যদিকে ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, বিলটি পাশের আগে অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিত সরকারের।
“এ ধরনের আইনের মাধ্যমে যেন মৌলিক অধিকার খর্ব না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। আইনের ধারা গুলো স্পষ্ট হতে হবে।”
“ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো কোনো ফাঁকফোকর যেন না থাকে। যাতে করে আইনটির অপব্যবহার না হতে পারে সেটি নিশ্চিত করে আইনটি চূড়ান্ত করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।