
করোনা সংকটে মানুষ আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। মানুষ পাপ মোচনের চেষ্টা করছে। অনেকে শুদ্ধ হয়ে যাবার চেষ্টা করছে। অনেকে মনে করছে তারা যে ভুলত্রুটি করেছে তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু মানুষ আছে, যারা মনে করছে এটাই সুযোগ এখন দুর্নীতি করতে হবে এবং দুর্নীতির একটা বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে করোনাকালে। আর সেকারণেই এই দুর্নীতিবাজরা যেন দুর্নীতির উল্লাসের নৃত্য করছে এবং এই করোনাকালে বাধাহীন দুর্নীতির উৎসব চলছে বিভিন্ন সেক্টরে। আমরা যদি দেখি যে, কোথায় কোথায় কীভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, তাহলে আমাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি
করোনার শুরু থেকে স্বাস্থ্য খাতে নানা রকম দুর্নীতির কথাবার্তা হচ্ছিল, চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছিল। কিন্তু এইসব দুর্নীতি বন্ধের জন্য কোনোরকম উদ্যোগ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে কথা বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন যে, এন-৯৫ লেখা থাকলেও সেটা এন-৯৫ মাস্ক ছিল না। অথচ যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই মাস্ক সরবরাহ করেছিল, সেই জেএমআই এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সেই কমিটি আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এটা নিয়ে যারা কথা বলেছিল তারাই উল্টো শাস্তি ভোগ করেছে। আর জেএমআই যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
শুধু মাস্ক কেলেঙ্কারি নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় যে সমস্ত উপকরণগুলো কিনছে সেগুলোর মান, মূল্য এবং কেনার স্বচ্ছতা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নগুলো যারা তুলছে তাদেরকেই খারাপ নজরে দেখছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের ভালো সম্পর্কের কথাই শোনা যায়।
সম্প্রতি যে পিসিআর মেশিনগুলো কেনা হয়েছে, সেগুলো নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে। থার্মোফিসার ৭৫০০ মডেলের যে আরটিপিসিআর মেশিনগুলো কেনা হয়েছে, সেগুলো ২০০৯ সালের মডেলের। সর্বশেষ মডেল না দিয়ে ঠিকাদাররা পুরনো মেশিন গছিয়ে দিয়েছে। এসব পুরাতন মেশিন দিয়ে ৯০টির বেশি পরীক্ষা করা যায় না। অথচ নতুন মেশিনগুলো দিয়ে ২৭০টির বেশি পরীক্ষা করা যেত। এর ফলে পরীক্ষার হার বাড়তো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এখন অস্বচ্ছ কেনাকাটার ধুম পড়েছে, কোন টেন্ডার ছাড়া যাকে যেভাবে পারছে, সেভাবে কাজ দিয়ে যেন দুর্নীতির উৎসব করা হচ্ছে।
ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি
করোনা মোকাবেলার জন্য শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরীব মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ওএমএস চালু করেন। কিন্তু শুরু থেকেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বাসা যেন চালের গোডাউনে পরিণত হয়। চাল-ডাল এমনকি সয়াবিন তেল পর্যন্ত উদ্ধার করতে হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে। এই সমস্ত দুর্নীতির কারণে যাদের ত্রাণ পাবার কথা ছিল তাদের অনেকেই ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকারি কাজে দুর্নীতি বেড়েছে
এই করোনার সময়ে সরকারি কাজে দুর্নীতি বেড়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। সরকার চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছেন সেখানে দুর্নীতি করা হচ্ছে। এমন অনেক চাল কলকে ক্রয় তালিকায় রাখা হয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। ট্রেন চলছে না, কিন্তু ট্রেনের নামে জ্বলানী উত্তোলন হচ্ছে। এরকম সব ক্ষেত্রেই বেসুমার দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি
সরকার ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেই প্রণোদনা বিতরণ করা হবে ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে দুর্নীতির কথা অতি পুরনো। এই সেক্টরের রাঘব বোয়ালরাই অনেক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এখন এই ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা, সেই প্রণোদনাও লুটপাট হবে কিনা তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছে।
নগদ সহায়তায় দুর্নীতি
সবচেয়ে যেটা ভয়াবহ, সেটা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সঙ্কটকালে কর্মহীন ৫০ লক্ষ পরিবার প্রতি আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এই আড়াই হাজার টাকার লোভও সামলাতে পারেননি। সেই টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারা শুরু করে দিয়েছেন।
এভাবে দুর্নীতির আষ্টেপৃষ্ঠে যেন ঘিরে গেছে সব সেক্টর। আর বাধাহীন দুর্নীতির কারণে করোনাসংকট ক্রমশ পুঞ্জিভূত হচ্ছে।