
দেশে প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার পরে নারায়ণগঞ্জকে দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত এক রোগীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় নির্মম মৃত্যু নিয়ে সন্তানের আবেগঘন এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুকে দুবার লাইভে এসে তিনি তুলে ধরেছেন ঘটনার আদ্যপান্ত। যেখানে ফুটে উঠেছে কুর্মিটোলা হাসপাতালের নার্স, স্টাফ ও আনসারদের চরম নির্মমতা।
নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ আখড়া এলাকায় ওই যুবক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমার বাবার করোনা পজিটিভ ছিল। তিনি ১৯ এপ্রিল সকাল ৭টায় ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আমি আপনাদের করোনার চিকিৎসার বিষয়ে কিছু ধারণা দিতে পারি। সবাই হয়তোবা মনে করছেন, আমাদের দেশে রোগটির ভালো চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু সত্যি ঘটনাটা আমি আপনাদের বলব, যেটা আমার বাবার মানে আমাদের সঙ্গে ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘বাবার করোনার লক্ষণ দেখা দিলে তাকে পরীক্ষা করাই। পজিটিভ থাকার বিষয়টি জানতে পারি ১৭ এপ্রিল। পরদিনই তাকে খানপুর হাসপাতালে নিয়ে যাই। কারণ আমি জেনেছিলাম খানপুর হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা করা হয়। সেখানে নেওয়ার পর জানতে পারলাম চিকিৎসা তো দূরের কথা রোগীটাকে ঠিকমতো দেখেও না। আর যদি জানতে পারে করোনা পজিটিভ তা হলে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে কুর্মিটোলায় যাই। সেখানে নেওয়ার পর ভর্তি করার কথা বললে ওখানকার লোকজন আমাদের জিজ্ঞেস করে আপনার বাবা যে করোনা পজিটিভ সেটার কোনো ডকুমেন্টস বা প্রমাণ আছে? আমি বললাম আছে। তখন বলা হয় কোনো কাগজ বা মেসেজ দেওয়া হয়েছে? তখন বলি ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আমার এ কথার ওপর ভিত্তি করে ভর্তি করতে রাজি নয়। পেপার অথবা মেসেজ লাগবে। যেখান থেকে জানানো হয়েছিল সেখানে যোগাযোগ করি। এদিকে বাবার অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। ভর্তির জন্য অনেক অনুরোধ করতে থাকি তাদের। এমনকি অসুস্থ বাবাও খুব কষ্ট করে তাদের অনুরোধ করেন। এতেও তাদের মন গলে না। মেসেজটি এলে বিকাল প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে বাবাকে ভর্তি করতে রাজি হয়।’
এর পর আরও নানা বিড়ম্বনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ তলা সেই তলা করে অনেক কষ্টে ৫ তলায় গিয়ে বাবার জন্য একটি বেডের ব্যবস্থা করি। সেটি ছিল একেবারেই নোংরা অপরিচ্ছন্ন। কোনো চাদর বা বালিশও ছিল না। তারপরও বাবাকে বসাই। কিন্তু রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি থাকতে দেবে না বলে আমাকে বের করে দেয়। মাকে রেখে নিচে চলে যাই। বাবার শ্বাসকষ্ট থাকায় মা নার্সদের কাছে গিয়ে অক্সিজেনের কথা বলেন। তখন তারা জানায়, আগে রোগীকে দেখবে এবং তখন যদি মনে হয় তার অক্সিজেন প্রয়োজন তা হলে দেবে। অনেকক্ষণ পর একজন এসে বাবার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। দেখার পর অক্সিজেন দেন। এতে তিনি কিছুটা ভালো অনুভব করেন। এর মধ্যে আবারও বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তখন মা আবার গিয়ে অক্সিজেন চান। এতে ওখানকার নার্স ও বয়রা মায়ের সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করেন। আমি বাইরে ওয়েটিং প্লেসে বসে থাকি। সন্ধ্যার দিকে সেখানকার এক আনসার আমাকে দেখে বলেন, আপনি এখানে কেন বসে আছেন? এখানে বসতে পারবেন না। আমি বললাম আমার রোগী আছে ওপরে, তাই বসে আছি। তখন তিনি বলেন, রোগী থাকলেও এখানে বসতে পারবেন না। আপনি রাস্তার ওই পাড়ে গাছের নিচে গিয়ে বসে থাকেন। আমি সারারাত কষ্ট করে রাস্তায় গাছে নিচে বসে থাকি। এদিকে বাবার শ্বাসকষ্ট কষ্টের কথা মা বারবার জানানোর পরও কোনো অক্সিজেন দেয় না তারা। অনেকবার বলার পর একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসে। তবে আমার মা বুঝতে পারে সিলিন্ডারটি খালি। সেটা লাগানোর পরও বাবার কোনো কাজ করছিল না। হাসপাতালটিতে শুরু থেকে আমরা কোনো ডাক্তার দেখিনি। শুধু নার্স ছিল। তারাও তাদের ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসে থাকে। রোগীর সঙ্গে কোনো লোক না থাকলে রোগী কিছু বলতেও পারবে না এবং সেখানেই সে মারা যাবে। কারণ নার্সরা রোগীর সামনেই আসে না। সারারাত আমি বাইরে থাকার পর ভোরের দিকে লুকিয়ে হাসপাতালে ঢুকি এবং বাবার কাছে যাই। এর কিছুক্ষণ পর তার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
এ সময় তাকে আইসিইউ কিংবা ভেন্টিলেশনে রাখার প্রয়োজন মনে করি। নার্সদের ওয়েটিং রুমের দিকে যাই। সেখানে আনসাররা আমাকে থামিয়ে দেন। নার্স পাঠাচ্ছে বলে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। প্রায় আধাঘণ্টা পরও নার্স না আসায় বাবার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে। তখন আবারও আমি তাদের অনুরোধ করি বাবার অবস্থা খুব খারাপ। দয়া করে আপনারা কিছু একটা ব্যবস্থা নেন। আমি তাদের পায়ে পর্যন্ত ধরতে যাই। তাতেও কাজ হয়নি। একটা সময় বাবার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যায়। তখন একজন নার্স আসে বাবাকে দেখতে। বাবা যে আর বেঁচে নেই বিষয়টি আমি জানতে পেরেও জিজ্ঞেস করি তার অবস্থা। তখন তিনি আমাকে বলেন আপনি নিজেই তো দেখতে পাচ্ছেন কী অবস্থা, তা হলে আবার আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? আমি যে আপাদের প্রথমেই বললাম যে বাবাকে আইসিইউতে নিয়ে যান। তখন কেন কোনো ব্যবস্থা নিলেন না? তখন তারা আমাকে বলে, আমাদের আইসিইউ খালি নেই। খালি না থাকলে কীভাবে আপনার বাবাকে নিয়ে যাব?’
এভাবেই ভাঙা ভাঙা গলায় কথাগুলো বলছিলেন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বৃদ্ধার ছেলে। বিনা চিকিৎসায় বাবার এমন নির্মম মৃত্যু পর তাদের জন্য যে আরও বাজে কিছু অপেক্ষা করছিল সেটা তিনি বুঝলেন লাশ হস্তান্তরের সময়। ধর্মীয় রীতিমতো সৎকারের জন্য লাশটি নিয়ে আসতে চাইলে সেখানেও নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে হয় তাদের। সকাল ৭টায় মৃত্যু হলেও সেই লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় রাত প্রায় ৮টা!
ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিও নিয়ে ওই যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গতকাল তিনি বলেন, ‘নিজেকে ভাইরাল করার জন্য লাইভে গিয়ে কথাগুলো বলিনি। আমি চেয়েছি আমরা যে সংকটময় পরিস্থিতি পার করেছি তা যেন আর কারও সঙ্গে না হয়। সবাইকে সচেতন করার জন্য আমার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করেছি। বর্তমানে এমন এক ভাইরাসের মহামারী শুরু হয়েছে যাতে করে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। প্রথমে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবার যে অবস্থা তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতেই আমি লাইভে এসে আমার জীবনের অভিজ্ঞতাটুকু শেয়ার করেছি। আমার জীবনের যা ক্ষতি হয়েছে সেটা পূরণ হওয়ার নয়। বাবাকে তো আর ফেরত পাব না। আমার এ কথাগুলো বলার পর যদি কেউ সচেতন হয় বা যদি এই সংশ্লিষ্টরা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার দিকে নজর দেন তা হলে হয়তো আমার বাবার আত্মা এতটুকু হলেও শান্তি পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুহাত জোড় করে মিনতি করছি আপনি একটু খোঁজ নিন। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আমার দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার কী অবস্থা? আপনি হয়তো জানেন না বা আপনাকে জানানো হয় না এমন অব্যবস্থাপনার বিষয়ে। আপনার কাছে অনুরোধ, আর কোনো সন্তানের চোখের সামনে যেন কোনো পিতাকে বিনা চিকিৎসায় এমন নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে না হয়। এখনই যেন এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
প্রসঙ্গত, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৫টি জেলাতেই কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই, অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ৭৩ শতাংশ, ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা।
ঢাকা শহরের পরেই বেশি রোগী রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। এই জেলায় মোট আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৪৯২ জন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আছেন ৩৬৪ জন। এখানে মারা গেছেন ৩৫ জন আর সুস্থ হয়েছেন ১৬ জন। এরপরে সংখ্যার দিক থেকে রয়েছে গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ এবং নরসিংদীর অবস্থান। ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলায় এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে।
পূর্বপশ্চিমবিডি