বরিশালে মাত্র একটি পিসিআর ল্যাব
ফিরে যাচ্ছেন উপসর্গধারীরা * টেকনোলজিস্ট সংকটে নমুনা সংগ্রহে জটিলতা * অগ্রাধিকার পাচ্ছেন আমলা, চিকিৎসক, পুলিশ * সুযোগ মিলছে হাতেগোনা সাধারণ কয়েকজনের
প্রায় কোটি মানুষের জন্য মাত্র একটি পিসিআর ল্যাব। করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য এ ল্যাবের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার কোটি মানুষকে। ফলে উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষা করাতে পারছেন না হাজার হাজার মানুষ।
প্রতিদিনই শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সামনে পরীক্ষার জন্য ভিড় জমাচ্ছেন মানুষ। তবে পরীক্ষা করানোর সুযোগ মিলছে হাতেগোনা কয়েকজনের। বাকিদের ৮ থেকে ১০ দিন পরের তারিখ দিয়ে স্লিপ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। করোনা উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে না পেরে কেউ কেউ ফিরে যাওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে। পুরো বিভাগে চলছে এমন পরিস্থিতি।
এর সত্যতা স্বীকার করে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কিছুই করার নেই। আর পিসিআর ল্যাবের কর্মকর্তারা বলেন, ইচ্ছে থাকলেও জনবলের তীব্র সংকটে শনাক্তকরণের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় জনবল থাকলে প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ থেকে ৬০০ পরীক্ষা করা যেত।
এখন বরিশালে হু হু করে করোনা শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ছয় জেলায় শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২১৮ জন। প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ৭৭ দিনে ৪৭ জন মারা গেছেন। তাদের ২৩ জন বরিশাল জেলার। বরিশাল জেলায় এক হাজার ২৮৮ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন। পিসিআর ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, ৭ এপ্রিল থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত এখানে প্রায় ১৬ হাজার করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ২১৮। শনাক্তের হার প্রায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
বরিশাল নাগরিক সমাজের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে বেশিসংখ্যক মানুষের শনাক্ত পরীক্ষার ওপর। শনাক্ত হলেই তার অবস্থান এবং সামাজিক সংস্পর্শ অনুযায়ী নেয়া যাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। এটা করা গেলে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে করোনা সংক্রমণ। মুক্তি পাওয়া যাবে করোনার হাত থেকে; কিন্তু আমাদের দেশে করোনা প্রতিরোধের প্রথম যে শর্ত ব্যাপক হারে পরীক্ষা- সেটিই মানা সম্ভব হচ্ছে না।
পিসিআর ল্যাবের প্রধান মাইক্রো বায়োলজিস্ট ডা. একেএম আকবর আলী বলেন, সক্ষমতা অনুযায়ী এ ল্যাবে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জনের পরীক্ষা করানো সম্ভব। কিন্তু লোকবল সংকটে তা হচ্ছে না। কমপক্ষে ৩৬ জন ল্যাব টেকনোলজিস্ট দরকার হলেও আছেন মাত্র ১০ জন। বর্তমানে সর্বোচ্চ ১৮৮টির বেশি পরীক্ষা করতে পারছি না আমরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার বলেন, টেকনোলজিস্ট সংকটে নমুনা সংগ্রহে জটিলতা হচ্ছে।
পুরো বিভাগে ১০২টি টেকনোলজিস্ট পদের মধ্যে ৫৯টি শূন্য। বিভাগের ছয় জেলার কোটি মানুষের জন্য কাজ করছেন মাত্র ৫৯ জন টেকনোলজিস্ট। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিন হাজার নতুন টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করছি এ নিয়োগ সম্পন্ন হলে জনবল সংকট কেটে যাবে।
এদিকে একমাত্র পিসিআর ল্যাবের ওপর ভরসা করতে গিয়ে নানা জটিলতার মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, শনাক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আমলাদের চাপ রয়েছে। এসব চাপ সামলে পরীক্ষা করানোর সুযোগ মিলছে না সাধারণ মানুষের। ফলে পরীক্ষা করাতে এসে ফেরত যাচ্ছেন অনেকে।
বরিশাল নগরীর ২১নং ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা জানান, করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় শেবাচিম হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে গেলে সাত দিন পরের তারিখ দিয়ে একটি স্লিপ তাকে ধরিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে আমার মৃত্যু হলে দায় কে নেবে? প্রায় একই কথা বলেন বরিশাল সদর উপজেলার কড়াপুর এলাকার বাসিন্দা এক নারী। করোনা ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, আগে বরিশালে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে ২০০ নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এখন ৫০-৬০টির বেশি নেয়া হচ্ছে না। শুধু বরিশালই নয়, বিভাগের অন্যসব জেলা-উপজেলাগুলোতেও একই অবস্থা।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ভোলা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বরিশাল পিসিআর ল্যাবে দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০টির বেশি পরীক্ষা করা হয় না। আমাদেরও বলে দেয়া হয়েছে এ হিসাব মাথায় রেখে জেলাওয়ারি নমুনা পাঠাতে। ফলে সবার চাহিদা অনুযায়ী নমুনা পাঠানো সম্ভব হয় না। ঝালকাঠি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষার জন্য নমুনা ঢাকায় পাঠালে প্রতিবেদন পেতে ৬ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। তাই আমরা বরিশালের ওপরই ভরসা করি। কিন্তু বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে পরীক্ষা করতে আসা মানুষের চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব এবং বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, ভয়াবহ সংক্রমণের এ সময়েও সরকার সবার করোনা পরীক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় জনবল থাকলে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, শুরুতে যেখানে মাত্র একটি ল্যাবের মাধ্যমে সারা দেশের সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের পরীক্ষা হতো, সেখানে এখন প্রায় ৫০টি ল্যাবে সারা দেশে এ পরীক্ষা হচ্ছে। এখনও একের পর এক ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা যে যুদ্ধ করছি তাতে ইনশাআল্লাহ পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে আসবেই।
শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, এখানকার ল্যাবের প্রধান টেকনোলজিস্ট ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। যারা কাজ করছেন তারা ততটা দক্ষ নন। ফলে কাঙ্ক্ষিত নমুনা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। এছাড়া পুরো বিভাগের জন্য মাত্র একটি পিসিআর ল্যাব থাকায় ছয় জেলার মানুষের চাপ পড়ছে এখানে। শুনেছি ভোলা জেলায় একটি পিসিআর ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। এছাড়া পটুয়াখালীতেও ল্যাব বসানোর ব্যাপারে ঢাকায় প্রস্তাব গেছে। এগুলোর কার্যক্রম শুরু হলে চাপ অনেকটাই কমে যাবে।
যুগান্তর