দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গত সোমবার হঠাৎ করেই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের স্ত্রী চুমকি কারণ। প্রায় ৪ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
মামলার এজাহারে প্রদীপের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধের অভিযোগ করা হয় চুমকির বিরুদ্ধে। মূলত এই মামলাটি দায়ের হওয়ার পর থেকেই চুমকি নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় প্রদীপ দম্পতির ছয় তলা বাড়ি লক্ষ্মীকুঞ্জে সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন চুমকি। সেই বাড়িতে গিয়ে চুমকিকে পায়নি দুদক। এরপর প্রদীপের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর সারোয়াতলীতে কয়েক দফা খোঁজ নিয়েও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। গ্রেফতার এড়াতে তিনি গত ১৯ মাসে ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করেন বলে জানা যায়। এক পর্যায়ে এমন কথাও ছড়িয়ে পড়ে যে চুমকি অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। চুমকি যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠিও দেয় দুদক।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার মতে, ঐ চিঠি দেওয়ার আগেই সন্তান নিয়ে চুমকি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা কিংবা আসামের গৌহাটিতে আত্মগোপনে রয়েছেন বলেও শোনা যেতে থাকে। প্রদীপ গ্রেফতার হন ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তিনি কারাগারে থাকলেও এর মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে তার একবারও দেখা হয়নি। স্বামীকে দেখতে কারাগারে বা আদালত এলাকায় যাননি চুমকি। মূলত এ কারণেই চুমকির ভারতে পালিয়ে থাকার যুক্তিটি সবাই সত্য বলেই মেনে নেন।
চুমকির অবস্থান নিয়ে তার স্বজনরাও সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। দুয়েক জন বলেছেন, স্বামীর গ্রেফতারের পর চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাটে এক আত্মীয়ের বাসায় কিছুদিন ছিলেন চুমকি। এরপর আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ছিলেন। গত সোমবার আদালতে আত্মসমর্পণের পর চুমকির আইনজীবী রেজাউল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, চুমকি কারণ দেশেই ছিলেন। তিনি ভারতে যাননি। দেশে ছিলেন বলেই আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।
দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর হঠাৎ করে কেন আত্মসমর্পণ করলেন চুমকি তা নিয়েও চলছে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা। আইনজীবী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, দুর্নীতি মামলায় পলাতক অবস্থায় বিচার শেষ হলে আইন প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন চুমকি। এখন তার আইনজীবী আইনে প্রদত্ত অধিকার অনুসারে সাক্ষীদের জেরা করা, সাফাই সাক্ষী হাজির করা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ পাবেন। এছাড়া পলাতক অবস্থায় বিচার হলে উচ্চ আদালতে পরবর্তী সময়ে আপিল করলেও তখন নিম্ন আদালতের আদেশই বহাল থাকার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলেন, আদালতে আত্মসমর্পণের দিনক্ষণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন চুমকি। তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের দিনেই। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রদীপ ও চুমকির দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি। তবে উচ্চ আদালতে প্রদীপের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষ্যগ্রহণ কিছুদিন পিছিয়ে ৪ এপ্রিল শুরু হয়। ইতিমধ্যে এ মামলায় ২৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত সোমবার মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুদক কর্মকর্তা ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন আদালতে সাক্ষ্য দেন। তার সাক্ষ্য প্রদানের আগেই চুমকি আদালতে আত্মসমর্পণ করায় চুমকি কীভাবে লাভবান হতে পারেন সে বিষয়ে চট্টগ্রামের সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের ভিত্তিতেই দুর্নীতির মামলাটিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাই আদালতে তাকে জেরা করা আসামিপক্ষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আসামি চুমকি কারণ আত্মসমর্পণ করায় এই মামলায় আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন করার সুযোগ পাবে। এছাড়া জামিন নামঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে চুমকির আইনজীবীর উচ্চ আদালতে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রদীপ ও চুমকি দম্পতির চট্টগ্রামের বাড়িসহ সমুদয় সম্পত্তি আদালতের নির্দেশে ক্রোক করেছে প্রশাসন। চুমকি এই আদেশের বিরুদ্ধেও আইনি লড়াই শুরু করতে পারবেন।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল দায়রা জজ আশফাকুর রহমান ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর নামে থাকা সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ প্রদান করেন।