
প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, এই মাসে রোগের প্রকোপ আরও বেড়ে যাবে। এটি ঠিক যে করোনাভাইরাস বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশকেও বিপর্যস্ত করে ছেড়েছে। কিন্তু এটিও সত্য যে, প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমরা অনেকদিন সময় পেয়েছিলাম। সেই সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বড় গলা করে এই সেদিনও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সবচেয়ে ভালো!
অথচ, দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা থেকে বারবার বলা হয়েছে যে, শনাক্তকরণের হার বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু আবুল কালাম আজাদের একগুয়েমির কারণেই দীর্ঘদিন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বাইরে আর কোথাও পরীক্ষা চালু করা সম্ভব হয়নি।
নানা অজুহাতে পরীক্ষার হারও তিনি বাড়াননি। একবার বলেছেন, সবার ল্যাবরেটরি নেই। আরেকবার বলেছেন, ল্যাবরেটরি ও কিট থাকলেই হবে না, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার কথাও মনে রাখতে হবে। এ-ও বলেছেন, কমিউনিটি সংক্রমণ হয়নি, তাই বেশি পরীক্ষার প্রয়োজনও নেই। অর্থাৎ কমিউনিটি সংক্রমণের অপেক্ষাতেই তিনি যেন বসে ছিলেন। কমিউনিটি সংক্রমণ যেন না হয়, সেই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার মাথাব্যাথা তার ছিল না। তিনি নিজে পরীক্ষার হার ও পরিধি বৃদ্ধির প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছেন, কিংবা আইইডিসিআর’কে দিয়ে বলিয়েছেন। অনেক দক্ষ, জনস্বাস্থ্য ও বায়োপ্রকৌশল নিয়ে অভিজ্ঞ সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে তিনি পরীক্ষা করার অনুমতি দেননি। বিভাগীয় ও বড় জেলা শহরে পরীক্ষা করতে দেননি। তার অনর্থক গোঁড়ামির কারণেই আজকে প্রস্তুতিতে এত পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের। ৬ই এপ্রিল সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকায় বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ার পর, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে টেস্ট করার হার বিশ্বে সর্বনিম্ন! আর মৃতের হার সর্বোচ্চ! একবারও কি এই অসামঞ্জস্য তার চোখে ধরা পড়েনি?
শেষ পর্যন্ত সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কিন্তু ঠিকই দুই ডজনের বেশি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মেডিকেল কলেজে কভিড-১৯ শনাক্তকরণের ল্যাব স্থাপন ও পরীক্ষা চালু হয়েছে বা হওয়ার পথে। একেবারে উপজেলা পর্যায়ের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টকে পর্যন্ত এখন অনলাইনে নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তাহলে কেন অত্যন্ত মূল্যবান গত দু’টি মাস অহেতুক নষ্ট করা হলো? বলা হয়, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। এখন হাজারও চেষ্টা করেও কি প্রলয় এড়ানো যাবে?
শুধু পরীক্ষার ক্ষেত্রেই নয়। তিনি বারবার আশ্বস্ত করেছেন যে, দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক পিপিই রয়েছে। চিকিৎসকরা পিপিই পাবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার থেকে তথ্য নিয়ে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই বলা হয় সকল চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পর্যাপ্ত পিপিই না থাকার কারণে অনেক চিকিৎসক সাধারণ রোগীদের দেখা থেকে বিরত থেকেছেন। ফলে করোনা আক্রান্ত না হয়েও ¯্রফে চিকিৎসার অভাবে অনেকে সাধারণ রোগে মারা গেছেন। মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকরা নিজ উদ্যোগে পিপিই ও মাস্ক সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এরই মাঝে করোনার বাইরেও যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল তার দায় নেবে কে? এখানে বলে রাখা ভালো, মহামারী ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থায় প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি। আইনেই তাকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ৫ ধারার ২ উপধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘‘এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালন এবং কার্য-সম্পাদনের জন্য [স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের] মহাপরিচালক দায়ী থাকিবেন।” এই ধরণের পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব তত্বাবধানের দায়িত্বে থাকেন। প্রশাসনিক ও নির্বাহি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি হলেন মহাপরিচালক।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে সবসময় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করার প্রচলন আছে। যেটি সবসময় অযৌক্তিকও নয়। কিন্তু অনেক সময়ই ফাঁক দিয়ে দায় এড়ান নির্বাহী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। এক্ষেত্রেও তা-ই ঘটছে। সবাই দোষারোপ করছেন মন্ত্রীকে। অনেকে দু’ কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন আইডিসিআর’র পরিচালককে, যিনি ¯্রফে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু যার হাতে সব সমন্বয়ের ক্ষমতা ন্যাস্ত করা, সেই আবুল কালাম আজাদ জবাবদিহিতা ও দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে, বিভিন্ন বেসরকারী মহল থেকে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিপুল সংখ্যাক পিপিই সংগ্রহে সহায়তা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আবুল কালাম আজাদ তখন ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছেন যে, তাদের হাতে পর্যাপ্ত পিপিই রয়েছে। দেশীয় বিভিন্ন কারখানা থেকে ক্রয়াদেশ দিয়ে পিপিই নেয়া হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা কী? ৫ই এপ্রিল জাতিসংঘের ঢাকাস্থ কার্যালয় থেকে একটি সিচুয়েশন রিপোর্ট তৈরি করা হয়, যেটির একটি কপি আমাদের হাতে এসেছে। এখানেই প্রকৃত পরিস্থিতি অনেকটা উঠে এসেছে। আবুল কালাম আজাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম) কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী প্রতি মাসে রোগীদের জন্য ৫ লাখ মাস্কসহ ১২ লাখ পিপিই সেট প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন এন৯৫ মাস্ক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাড়ে ৩ লাখের মতো পিপিই সংগ্রহ করতে পেরেছে। বিতরণ শেষে আর হাতে আছে মাত্র ৪২-৪৩ হাজার। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মানের অর্থাৎ লেভেল ৩-এর পিপিই আছে মাত্র ১০ হাজার! স্থানীয় বিভিন্ন কারখানা থেকে যেসব পিপিই কেনা হয়েছিল, আর ফলাও করে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল, সেগুলো সব লেভেল ১-এর পিপিই। এসব পিপিই’র কার্যকারিতা অনেক কম। যারা সরাসরি রোগীর আশেপাশে যাবেন, পরিচর্যা করবেন, তাদের অবশ্যই লেভেল-৩ পিপিই পরতে হয়। এসব স্বাস্থ্যকর্মীকে অবশ্যই এন৯৫ মাস্ক পরতে হয়। কিন্তু চীন সরকার ও জ্যাক মা ফাউন্ডেশন থেকে যেই ৪৫ হাজার এন৯৫ মাস্ক দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে চলবে মাত্র ১০ দিন।
এই ভয়ঙ্কর তথ্য জাতির কাছ থেকে তো বটেই, সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে আবুল কালাম আজাদ যথাসময়ে অবহিত করেননি। এখন উপায় না দেখে আন্তর্জাতিক আংশীদারদের কাছে হাত পেতেছেন। এই চরম ব্যার্থতার দায়ভার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান ও আইনগতভাবে সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন ও কার্যসম্পাদনে দায়বদ্ধ প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আবুল কালাম আজাদকে অবশ্যই নিতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ মহলকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেই ব্যক্তি এতদিন ধরে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের অজ্ঞতা ও অদক্ষতা গোপন করার জন্য তাদেরকে বিভ্রান্ত করে আসছেন, তার হাতে ভবিষ্যতের হাল ছেড়ে দেয়া উচিৎ হবে কিনা।